উৎসব তার নয়;রক্ত যার

প্রকাশক: Dainik Jagroto Matrivumi JM TV
প্রকাশ: 7 hours ago

লেখক :জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

যখন দেশের আকাশে যুদ্ধের গন্ধ ভাসে, রাজপথে নামে মিছিল, রাস্তায় জ্বলে আগুন—তখন রাজনীতিকেরা ব্যস্ত থাকে কৌশল তৈরিতে, ব্যারিকেডের পেছনে দাঁড়িয়ে দেয় নির্দেশ, বুলেট ঠেকায় না। ধনিকরা তখন তোষণের ছায়ায় থাকে, নিরব নিরাপত্তা ঘেরা দালানে বসে পাঠায় কিছু খাদ্যদ্রব্য, কিছু টাকার চেক। আর যারা অস্ত্র হাতে নেয়, বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বন্দুকের মুখোমুখি—তারা সাধারণ, তারা গরিব, তারা চাষার ছেলে, ঠেলাগাড়ি চালানোর ছেলেটা, কিংবা সেই বৃদ্ধা যার কাঁধে একমাত্র সন্তানের স্মৃতি ঝুলে আছে।

দেশের সব বিপ্লব, সব যুদ্ধ, সব সংকটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় এই মানুষগুলো। তারা জানে না রাষ্ট্রবিজ্ঞান, জানে না কূটনীতি, শুধু জানে—বাঁচার একটাই পথ, রুখে দাঁড়ানো। তাদের শরীরেই ঝরে রক্ত, তাদের হাতেই গড়ে ওঠে স্বাধীনতা, তাদের কাঁধেই চলে শহীদের কফিন। তবু ইতিহাসে তারা থাকে না।

যুদ্ধ শেষ হলে মঞ্চে ওঠেন নেতারা। মুখে রাজনীতির সাহসী গল্প, হাতে ক্ষমতার পতাকা, পেছনে দেশপ্রেমের হ্যাশট্যাগ। তারা বলে, “আমরা স্বাধীনতা এনেছি।”

ব্যবসায়ী আসে নতুন বাণিজ্যের ছকে, যেখানে প্রতিটি রক্তের দাগকে রূপান্তর করে মুনাফায়। স্বাধীনতা হয়ে ওঠে তাদের জন্য উৎসব, বিজয়ের ফানুস উড়ে রাজধানীর আকাশে।

এদিকে গরিবেরা? তারা তখন হাসপাতাল খোঁজে, খোঁজে একটা ছবি—যেখানে হয়তো ছেলের মুখ আছে, অথবা মেয়ের পরিচয়পত্র। তাদের ঘরে ঢোকে না জাতীয় পতাকা, ঢোকে ক্ষুধা আর নিখোঁজের ভয়।
তারা যুদ্ধ দিয়েছিল, আজও যুদ্ধে আছে—জীবন যুদ্ধ, বেঁচে থাকার যুদ্ধে। স্বাধীনতার পরে তাদের হিস্যা শুধু স্মৃতির ভার আর রাষ্ট্রের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি।

ইতিহাস বারবার একই দৃশ্য মঞ্চস্থ করে। পলাশীর প্রান্তর থেকে ৭১, কিংবা ২০২৪—সবখানেই পর্দার আড়ালে থাকে এক মহাবঞ্চনা। যুদ্ধ আর রক্ত গরিব দেয়,স্বাধীনতা আর সরকার ধনীরা নেয়।

২০২৪ সালে আবারো প্রমাণ হলো—রাজনীতি বদলায়, মুখ বদলায়, প্রতিশ্রুতি বদলায়, কিন্তু ভাগ্য বদলায় না সেই ছেলেটার, যার নাম কোনো শহীদ মিনারে লেখা থাকে না, কেবল মায়ের কাঁধে থাকে ছবি হয়ে। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন আসে, মানুষ ভোট দেয়, কিন্তু কিছুই বদলায় না। বাড়ে কেবল পণ্যের দাম, বিদ্যুতের বিল, আর নেতা-নেত্রীর গাড়ির বহর। দেশের মাটি সোনা ফলায় না, ফোটায় ঘাম, রক্ত, আর দীর্ঘশ্বাস।

তবু তারা ভালোবাসে দেশ। সেই ভালোবাসা কখনো পতাকার রঙে, কখনো সন্তানের নামে রাখা স্কুলে, কখনো কবরের পাশে ফেলে আসা গোলাপফুলে।
তারা যুদ্ধ চায় না, তবু যুদ্ধ বাধলে সবার আগে ছুটে আসে, কারণ তারা জানে—দেশ না থাকলে ঘর থাকে না। কিন্তু ঘর থাকলেও, তাদের জন্য দেশ থাকে না।

স্বাধীনতা তাদের অধিকার নয়, বরং তাদের সান্ত্বনা। বিজয় দিবস মানে তাদের কাছে একটি ফুল, যেটা তারা রেখে আসে কবরের গায়ে, আর একটি দীর্ঘশ্বাস, যেটা চলে যায় আকাশে।
রাজনীতি তাদের দেখে না, রাষ্ট্র তাদের ডাকে না, মিডিয়া তাদের চেনে না। তারা আছে শুধু গণনার বাইরে, সংবেদনশীলতার সীমানার ঠিক ওপারে।

তবু ইতিহাস যদি একদিন চোখ খোলে, যদি সত্যিই একদিন নতুন পৃষ্ঠা লেখা হয়— তাহলে সেই পৃষ্ঠায় থাকবে না কোনো প্রেসিডেন্টের নাম, কোনো সাইনবোর্ডধারী নেতার মুখ, কোনো মুনাফা করা শিল্পপতির পদবি। সেই পৃষ্ঠায় লেখা থাকবে—
“রক্ত দিয়ে যারা স্বাধীনতা কিনেছিল, উৎসব তাদের ছিল না।”