রিয়াজুল হক সাগর, রংপুর
রংপুর নগরীর বিভিন্ন হাট বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, মাসখানেক ধরে সব নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েই চলেছে। চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ ছাড়াও সবজি, মাছ, মাংস, মুরগিসহ সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সবজির বাজার সীমাহীন বেড়েছে। সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেল, দুদিন আগের ৩০-৪০ টাকার করলা-পটোল ৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪২০ টাকা, ১০ টাকা আঁটির কলমি শাক ২০, ২০ টাকা কেজির পুঁইশাক ও পেঁপে ৩০ ও ৪০ টাকা, বড় বেগুন ৮০, ছোট লম্বা বেগুন ৬০ টাকা। এ ছাড়াও ৪০ টাকার বরবটি ৬০-৭০ টাকা , ৪০ টাকার কচুমুখী ৬০, ৬০ টাকার বাঁধাকপি ৮০, মাঝারি আকারের লাউ ৬০ থেকে ১০০, ৪০ টাকার চিচিঙ্গা ৭০, ৩৫ টাকার কাঁকরোল ৭০, ৩০ টাকা কেজির মিষ্টিকুমড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়েছে। বাড়েনি শুধু পিয়াজের দাম ১০০-১২০ টাকা কেজির মধ্যে রয়ে গেছে।রংপুর শহরে ছোট একটি চাকরি করেন খোকন মিয়া। বেতনের বড় একটি অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। বাড়তি হাতে যা থাকে, তা দিয়ে টেনেটুনে চলে পুরো মাস। মাছ-মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন ভরসা ছিল সবজি-ডিমের ওপর। কিন্তু এখন যে অবস্থা সবজিও তাঁর কাছে বিলাসী পণ্য মনে হচ্ছে। কীভাবে পরিবার নিয়ে চলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।নগরীর চকবাজার এলাকা টিটু সবজি কেনার সময় হতাশার সুরে বলেন, ‘চোখে অন্ধকার দেখছি। পরিবার নিয়ে জীবনটাকে কীভাবে চালাব বুঝতে পারছি না। পরিবারে সব খাতে ব্যয় কমিয়েছি, তারপরেও টানাটানি। সবজি কিনব সেই অবস্থাও নেই। দাম শুনে মাথা ঘুরে যায়। এখন বাজারে আসার কথা শুনলেই মনটা বিষিয়ে ওঠে।নগরীর কেডিসি রোডে থাকেন অটো রিক্সা চালক জসিম। দৈনিক ৭০০-৮০০ টাকা অনুসারে মাসে সর্ব সাকুল্যে আয় ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। এর মধ্যে সাত হাজার টাকা গাড়ি ভাড়ায় চলে যায়। বাকি টাকা দিয়ে চারজনের সংসার টিমটিমিয়ে চলে। জসিম বললেন, সবজি কিনছি তাতেই ৩৫০ নাই। এরপর অন্য বাজারসদাই। ক্যামনে হামার জীবন চলে বাহে একটু অঙ্ক মেলান!আল-আমিন, টিটু ও জসিমের মতো বাজার পরিস্থিতি নিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে মানুষের। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত আরো ছয়জনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানালেন, বাজারে সব জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। মাঝারি মানের চালের কেজি ৭০ টাকা। ফার্মের ডিমের হালি ৫২ টাকা, গরীবের ইলিশ পাঙাশ ২২০-২৮০ টাকা, রুই ৩৫০ টাকা, কুচো চিংড়ি ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। সব সবজির দাম আকাশছোঁয়া। কিন্তু আয় এক পয়সাও বাড়েনি। ধারদেনা কিংবা সঞ্চয় ভেঙেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো টানাপোড়েন ঘোচাতে পারছে না। এর মধ্যে ধাপে ধাপে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।এদিকে কয়েকজন কলেজ ছাত্র এসেছে ম্যাচের খরচ করতে, তারা মরিচ ৫ টাকা , শুকনো মরিচ ৫ টাকার, আদা ৫ টাকার ও সবজি দাম করে হাফ কেজি করে কেনেন। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা ম্যাচের খরচ করতে আসছি। ম্যাচে দৈনিক জন প্রতি খাবার ফি ৪০ টাকা করে তুলি চাল নিজের ম্যাচে থাকি ৪০ জন কিন্তু সবসময় কেউ না কেউ থাকে না আজ রাতে ৩৫ জনের খরচ করছি বাজারে এসে মাঠা ঘুরাচ্ছে সবজি ও অন্যান্য জিনিসের দাম শুনে। কি আর করার কষ্ট করে অল্প খেয়ে থাকা আরকি। এছাড়া উপায় নাই।এ ব্যপারে লালবাগ বাজারের সবজি বিক্রেতা খলিল বলেন, আমরা যে সবজি কিনতাম ৩০ টাকায় এখন সেটা কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। দাম তো আর আমরা বাড়াই না। বেশি দামে কিনি, বেচতেও হয় বেশি দামে। আমাদের কি করার।বাজারের ব্যবসায়ীরা জানালেন, সবজির দাম চড়া হওয়ায় এখন ক্রেতারা কিনছেনও কম। আগে যিনি এক কেজি কিনতেন, এখন তিনি ২৫০ গ্রাম কিংবা আধা কেজি কিনছেন। অনেকেই আবার দাম শুনে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছেন।সবজি ব্যবসায়ী আলম হোসেন বললেন, ‘আগের চাইতে বেচাবিক্রি অনেক কমে গেছে। দাম বেশি হওয়ার কারণে মানুষ অল্প অল্প কেনে। বাজারে সবজির সরবরাহ কম, তাই দামও বেশি। তবে এবার সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। হয়তো বন্যার কারণে এই অবস্থা হয়েছে।’ব্যবসায়ী রবিউল বলেন, ‘পাইকারি হাটে গেলে মাথা ঘোরে দাম শুনে। পাইকারেরা কথা বলে টেরা ভাষায়। কলে, ভালো লাগলে নেন, না লাগলে পথ দেখেন। দাম বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোকামে সবজি কিনতে গ্যালে আমরাও এই প্রশ্ন পাইকারি ব্যবসায়ীদের করি। তারা বলে, মোকামে মালের সংকট, তাই দাম বেশি।কারমাইকেল কলেজের সহকারি অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) আব্দুর রউফ বলেন, মধ্যবিত্ত মানুষের মাছ-মাংস কেনার সাধ্য ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। শাকসবজি কেনার সাধ্য থাকলেও অস্বাভাবিক দামের কারণে এখন সেগুলোর ধারের কাছে ভেড়া কঠিন। নিত্যপণ্যের দাম অস্থিতিশীল হওয়ায় মানুষ ভীষণ কষ্টে আছেন। এটা কেউ বুঝতে চান না।তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে বাজারের সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। চাহিদা নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। চাপ প্রয়োগ করে নয়, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে বাজার সহনীয় রাখতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের নজরদারি প্রয়োজন।