জনপ্রিয়

২০২৫ সালে নারী নির্যাতন: সভ্যতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের দৃষ্টান্ত

প্রকাশক: Dainik Jagroto Matrivumi
প্রকাশ: 1 month ago

লেখক-জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

সমাজের উন্নতির দিক থেকে যেমন আমরা সাফল্যের মুকুট মাথায় পরি, ঠিক তেমনি সেই সমাজের অন্ধকার দিকগুলোও আজ আমাদের বিবেককে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। নারী, যাকে একসময় পৃথিবীর অর্ধাঙ্গিনী বলা হতো, সেই নারী আজও নির্যাতনের শিকার। তার স্বপ্ন, তার নিরাপত্তা, তার মৌলিক অধিকার—সব কিছুই প্রতিদিন খর্বিত হয়ে চলেছে। ২০২৫ সালের প্রথম মাসেই ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সেই অমানবিক বাস্তবতাকেই আবারও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। নারীর প্রতি এই সহিংসতা, এই নির্মমতা—কবে থামবে?

ঢাকার গুলশান এলাকা থেকে শুরু হওয়া এক ঘটনা যেন সমাজের বিবেকের গলা চেপে ধরেছে। সেখানে এক তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়, আর তার পাশে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা শূন্য। রাস্তায় ভিড় জমে, কিন্তু কেউ সেদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যায়। ওই তরুণী যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে ভীষণ দুঃখের সাথে বুঝতে পারে, এই সমাজে তার সম্মান, তার আত্মমর্যাদা—কোনো কিছুই নিরাপদ নয়। সে কি ভেবেছিল, এই শহরে সে নিজের মতো করে বাঁচবে? যে সমাজ নারীকে সম্মান দেয় না, সেখানে তার জীবন কি কোনো অর্থ বহন করে?

চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্টস কারখানার ঘটনায় এমন এক নারীর দুঃখজনক পরিণতি ঘটেছে, যা আমাদের পুরো মানবিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। এক তরুণীকে তার সহকর্মী ধর্ষণের পর হত্যা করে, এবং হত্যা করার পর তার শরীরকে এমনভাবে রাখা হয়, যেন তার জীবন কোনো মূল্যই রাখে না। রক্তের শেষ ব滴 গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু সমাজের চোখে তা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা মাত্র। তার বেঁচে থাকার অধিকার, তার প্রতিরোধ, তার আত্মসম্মান—কিছুই আর রক্ষা পেল না। তারপরও, এই ঘটনার বিচার কি যথাযথ হয়েছে? নাকি আমরা আবারও চুপ করে দেখে যেতে থাকবে, যতদিন না আরেকটি মা তার সন্তানকে হারায়?

রাজশাহীতে ঘটেছে আরও এক হৃদয়বিদারক ঘটনা—এক কিশোরীকে অপহরণ করা হয়, তারপর নির্যাতন। তার চিৎকার, তার কান্না—এসব যেন তীব্র বাতাসে মিশে গেছে, কেউ শুনতে আসেনি। একটি শিশুর innocence কীভাবে হারিয়ে যায়, সেটা ভেবেও কষ্ট হয়। তাকে হয়তো কেউ প্রশ্ন করেনি—কেমন আছো? তোমার মনের মধ্যে কত না যন্ত্রণা! কিন্তু তাতে কী আসে যায়? সমাজ যেন পুরনো ক্ষতের উপর লেপটে বসে থাকে। নতুন কোন ক্ষত হতে চায় না, সে নিজেই গলিত হয়ে গেছে।

এই ঘটনা গুলো শুধুমাত্র পরিসংখ্যান নয়, এগুলি হল আমাদের আত্মবিশ্বাসের ওপর খোঁচা, আমাদের মানবিকতার ওপর কলঙ্ক। ২০২৫ সালে এসে, আমরা কি নারীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত? আমাদের আইনের কাঠামো কি নারীদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম? নাকি এই আইন কেবল কাগজে-কলমে, সমাজের মন থেকে অনেক দূরে?

আইন বলে, ধর্ষণ বা সহিংসতার শিকার হলে অপরাধীর শাস্তি হবে, মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু বাস্তব কী? সমাজের অচল বিচারব্যবস্থা, শ্লথ আইনি প্রক্রিয়া, বিচারহীনতার সংস্কৃতি—এসবই অপরাধীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। অপরাধীরা জানে, আইন প্রয়োগে দেরি হলে, তাদের শাস্তি হয় না। তারা জানে, সামাজিক চাপ কমে গেলে তাদের শাস্তি দূরে চলে যায়। আর এই অবস্থা সমাজকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
তবে, পরিবর্তন কিছু কিছু জায়গায় আসছে। নারীরা প্রতিবাদ করছেন, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছেন। কিন্তু পরিবর্তন কি যথেষ্ট? না, পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন পুরো সমাজ এক হয়ে নারীর প্রতি সম্মান, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। শুধু আইন নয়, আমাদের মন-মানসিকতা বদলাতে হবে। আমাদের সমাজে নারীরা কেবল ‘দুর্বল’ নয়, তাদের শক্তি, সম্মান, নিরাপত্তা এক মানবিক অধিকার।

যতদিন না নারী তার প্রতিটি পদক্ষেপে নিরাপদ বোধ করবে, ততদিন আমাদের সভ্যতার মাপকাঠি প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। আমাদের চোখে, অন্তরে, সমাজে নারীকে সম্মান দেওয়া হবে—এই স্বপ্নের ভিতর দিয়ে সমাজ একটি নতুন আলো দেখতে পারে, যেখানে নারী মুক্ত, নিরাপদ এবং মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারবে।

কিন্তু, যতদিন এই পরিবর্তন আসবে না, ততদিন নারীর কান্না, তার কষ্ট, তার প্রতিবাদ—এসব যেন বাতাসে মিশে থাকে। এবং আমরা সবাই জানব, এই সমাজের কলঙ্ক আমাদেরও অংশ।

লেখক, শিক্ষার্থী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।

  • ২০২৫ সালে নারী নির্যাতন: সভ্যতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকারের দৃষ্টান্ত