জনপ্রিয়

সাতক্ষীরার ঐতিহ্য সুন্দরব‌নের প্রাকৃ‌তিক চাঁ‌কের মধু ও মধুর সংগ্রহ ইতিহাস

প্রকাশক: Dainik Jagroto Matrivumi
প্রকাশ: 9 months ago

রাকিবুল হাসান, সাতক্ষীরা শ্যামনগর প্রতিনিধিঃ 

জানা অজানার সুন্দরবন। আ‌দিকাল থে‌কে রুপ রহস্যঘেরা স্বাপদ সংকুল সুন্দরবন আমা‌দের কা‌ছে অ‌নেক রুপসী সুন্দর। ত‌বে সবার কা‌ছে এটা ভয়ঙ্কর সুন্দর। এ ব‌নে পাখপাখালী, নদনদী‌তে মাছ, কাঁকড়া, মধু, ব‌নের প‌রি‌বেশ, বনজ সম্পদ, বন্য প্রানী সব মি‌লে জীব ও বৈ‌চিত্রের জন্য বিখ্যাত এ বন। লবন জোয়া‌রের ম্যানগ্রোভ ফ‌রেস্ট না‌মে খ্যাত এ বন‌টি পৃ‌থিবীর অন্যান্য ব‌নের তুলনায় খুবই অ‌নিরাপদ এক‌টি স্থান। জ‌লে কু‌মির, ডাঙ্গায় বাঘ, জলদস্যু অনা‌দিকাল থে‌কে ভৌ‌তিক উপখ্যান মি‌লে রহস্যময় এ বন। নানা যাদু গু‌নিন ক‌রে বাঘ ও দেউদা‌নো আটকা‌নো, মা বনোবি‌বি, গাজী কালু ও দেব‌দেবীর না‌মে স্থানীয় অ‌ধিবা‌সীরা যে যার সম্প্রদায়গতভা‌বে অর্থ মান্নত ও বিশ্বাসী । 

মধু উৎসবঃ

প্রতি বছর ১ এপ্রিল মধু সংগ্রহের বন‌বিভা‌গের অনুম‌তি মে‌লে। মধু মৌসুম আস‌লে খুব বে‌শি  ঘটা ক‌রে  মধু উৎসবও হয়। আর বে‌শি ক‌রে শুরু হয় বা‌ঘে ধরার ঘটনাও । কারণ মাওয়ালরা মধুর জন্য একাকী তন্ন তন্ন ক‌রে ব‌নে মধু খো‌জে। একসময় বন এলাকায় বছ‌রে শত শত মানুষ বা‌ঘের মু‌খে নিহত হ‌ত। বর্তমা‌নে হয়‌তো কিছুটা কম। গ্রা‌মের ভাষায় মৌ খোজা না বাঘ খোজা একই কথা। তার পরও প্রতিবছর এ‌প্রিল মে (‌ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ)  মধু মৌসুম আস‌লে মৌ উৎসব শুরু হ‌য়ে যায় উপকূ‌লে। মাওয়াল‌ মা‌ঝি‌দের নৌকা সাজা‌নো, মহাজন‌দের (অ‌গ্রিম টাকা) গনদাদন প্রদান মি‌লে উৎসব মুখর প‌রি‌বেশ হয়।

মাওয়ালঃ

 মাওয়াল একটা বংশ পরমপরায় চলমান পেশা। এলাকায় গ‌ল্পে  জানা যায় প‌রিবা‌রের পিতা, চাচা সবাই‌কে বা‌ঘে খে‌লেও বং‌শের লো‌কেরা আবার মাওয়ালে যায়। প্রতিবছর নিয়‌মিত মাওয়ালরা মা‌ঝির নেতৃত্ব দেয়। এটা থে‌কে বড় কোন অর্থ আ‌সেনা তবুও পেশা‌কে নেশার মত ম‌নে হয় মাওয়াল‌দের কা‌ছে। তাই তারা প‌রিবা‌রের কাছ থে‌কে শেষ বিদায় নি‌য়ে, বিপদমু‌ক্তির জন্য দোওয়া, মেলাদ নি‌য়ে, গ্রামবা‌সি ও প‌রিবার প‌রিজ‌নের চো‌খের জ্বল উ‌পেক্ষা ক‌রে ব‌নের দি‌কে নৌকা ছোটায় জী‌বিকার টা‌নে। প্রতিবছর এভা‌বে মৃত্যুকে হা‌তের মু‌ঠোয় রে‌খে মধু সংগ্রহ কর‌ছে মানুষ। মধু সংগ্রহ সুন্দরবন এলাকায় নতুন কিছু নয়, অ‌তি প্রাচীন। বংশ পরমপারায় এ পেশায় জড়িতরা দুঃসাহসী হ‌য়ে ও‌ঠে যখন ‌বেশি বে‌শি মধু নি‌য়ে ফি‌রে আ‌সে। এটা তা‌দের কা‌ছে সব থে‌কে গ‌র্বের। মধু ও ঐ‌তিহ্য ধ‌রে রাখ‌তে প্রতি বছর শত শত মধু নৌকা সুন্দরব‌নে যায়, তন্ন তন্ন ক‌রে মধু খো‌জে তারা। 

মহাজনী ঋণ গ্রহনঃ

সুন্দরব‌নে মধু সংগ্রহের জন্য বন‌বিভাগ অনুম‌তি পাশ (পার‌মিট) দেয় প্রতি ১ এ‌প্রিল থে‌কে। সুন্দরব‌নে মধু থা‌কে ৩ মাস, এ‌প্রিল মে ও জুন। ত‌বে এ‌প্রিলের মধুটা খ‌লিশা ফু‌লের, প‌রে পর্যায়ক্রমে গরান, কেউড়া বাইন ও গেওয়া মিশ্রফু‌লের। বন বিভাগ থে‌কে ১৫ দি‌নের ক‌রে অনুম‌তি নি‌য়ে ব‌নে যায় এক‌টি নৌকায় ৭ থে‌কে ৯ জ‌নের এক‌টি টিম। এই টি‌মের সাজ সজ্জা ব‌নে প্রবে‌শের খাদ্য ও উপকরণ প্রদান ক‌রেন একজন  মহাজন। মধু সংগ্রহ ক‌রে ফি‌রে এ‌সে মধু মহাজন‌দের কা‌ছে বিক্রয় কর‌তে হয় স্থানীয় রে‌টে। 

মধু সংগ্রহের পদ্ধ‌তিঃ

সুন্দরব‌নে মধু সংগ্রহের পদ্ধতী এখ‌নো প্রাচীন। সনাতনী পদ্ধ‌তিও ব‌লে। টি‌মের সর্দার‌কে সাজু‌নি ব‌লে। যারা মধু বহন ক‌রে তা‌দের আ‌ড়িওয়ালা (হাঁ‌ড়িওয়ালা) ব‌লে। যি‌নি গা‌ছের ডা‌লে চ‌ড়ে মধু দা দি‌য়ে কা‌টেন তা‌কে কাট‌নি মাওয়ালী ব‌লে। একজন খেজুরপাতা ও বি‌ভিন্ন লতাপাতা দি‌য়ে কাড়ু তৈরী ক‌রে প্রাকৃ‌তিক ধোওয়া দেন চাঁ‌কে। একজন লো‌কেরা প্রথ‌মে ধামা/বে‌তের গামলায় চাঁকসহ মধু ধ‌রেন। প‌রে হাত দি‌য়ে মধু চেপেঁ ড্রা‌মে ভ‌রেন। এই সনাতনী পদ্ধ‌তি‌তে মধু সংগ্রহ ক‌রেন প্রায় ৯৯% মাওয়াল। বর্তমা‌নে বি‌ভিন্ন প‌রি‌বেশবাদী সংগঠনের প্রশিক্ষন ও উপকরণ সহায়তায় কিছুটা  আধু‌নিক উপা‌য়ে স্বাস্থ্যসম্মত উপা‌য়ে মধু সংগ্রহ করার উ‌দ্দোগ গ্রহন করা হ‌লেও মাওয়াল‌দের ভিত‌রে তেমন সাড়া জা‌গে‌নি। 

ত‌বে সরকারী নি‌র্দেশমতে মধু সংগ্রহের কিছু নি‌র্দেশনা দেওয়া হ‌য়ে থা‌কে।

 অপ‌রিপক্ষ মধু সংগ্রহ না করা, মধু‌তে ‌ধোওয়া কাড়ুর ছাই না ফেলা‌নো, হ্যান্ড গ্লোভস ব্যবহার ক‌রে মধু চাঁপা, মধুর চাঁ‌কের পরাগ স্থ‌রের (গুট‌লি) মধুর সা‌থে মিশ্র না করা, মধু‌র ড্রা‌মে লবন পা‌নি প্রবেশ বন্ধ করা। মধু ভাল ভা‌বে ছাক‌নি করা। 

মাওয়ালরা সাধারণত সুন্দরব‌নের গহী‌নে যেখা‌নে বড় গাছ আ‌ছে সেখা‌নে মধু বে‌শি পায়। মধু সংগ্রহের স্থান সাধারণ খাল, নদী থে‌কে ব‌নের গভী‌রে হয়। মাওয়ালনা ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে লাইন ধ‌রে ব‌নে ছাটা দেয়। প্রায় ৮ জন মাওয়াল ১\২ আধা কি‌.মি  এলাকা ছ‌ড়ি‌য়ে ছাটা দেয় ব‌নে। মধু চাঁক দেখ‌লে শিঙ্গায় ফুক দেয় অথবা যে যে ধর্মবিশ্বাসীরা ধর্মীয় বানী ব‌লে চিৎকার ক‌রে। তখন পা‌শের থে‌কে ৩ জন একত্র হ‌য়ে মধু‌টি সংগ্রহ ক‌রে নেয়। এলাকার সাহ‌সী মাওয়াল ছাড়া জীব‌নের ঝুঁ‌কি নি‌য়ে ব‌নের ভিত‌রে কেউ যে‌তে পা‌রেনা। শুধু মাত্র ছ‌বির জন‌্য ফ‌টোগ্রাফাররা নিকটস্থ জঙ্গ‌লে কোন মধুর চাঁ‌কের ছ‌বি গ্রহন ডকু‌মে‌ন্টেশন তৈরী ক‌রেন। কিন্তু সাধারণত মাওয়াল‌দের সা‌থে গহীন ব‌নে যাওয়ার সু‌যোগ হয় না।

মধুর বিশুদ্ধ প্রক্রিয়াঃ

সুন্দরব‌নের মধু নি‌জেই বিশুদ্ধ, প্রাকৃ‌তিক চাঁ‌কের মধু‌তে ব‌নের লতাপাতা, মৌমা‌ছি, ফু‌লের পরাগ, মো‌মের অংশ থা‌কে। এটা মধুর তেমন ক্ষ‌তি ক‌রেনা ব‌লে মাওয়ালরা জানান। মধু‌তে এ সকল ময়লা থাক‌লে সাধারণত উপ‌রে ভে‌সে ও‌ঠে। ছাক‌নি দি‌য়ে মধু প‌রিস্কার ক‌রে সাধারণত প্রাকৃ‌তিক চাঁ‌কের মধু খাওয়া যায়। অ‌নেক কারখানায় মধু রিফাইন ক‌রে বোতল জাত করা হয় ত‌বে সেখা‌নে শুধুমাত্র মধুতে মোম ও কা‌ঠের সুক্ষগুড়া গু‌লো বের করা হয়, তেমন কোন উপাদান মধু‌তে ব্যবহার করা যায় না, কারণ মধু  সাধারণত প্রাকৃ‌তিকভা‌বে বিশুদ্ধ থা‌কে।

মধুতে ভেজাল প্রবনতাঃ

বর্তমান চাষীমধু‌তে ও সুন্দরব‌নের মধু‌তে চি‌নি ও অনন্য কে‌মিক্যাল মি‌শ্রিত করা হচ্ছে। সুন্দরবন এলাকার অ‌নেক মহাজন ও মাওয়ালরাও যুক্ত হ‌চ্ছে মি‌শ্রিত চি‌নি মধু বিক্রয়ে। আবার সাতক্ষীরাসহ দে‌শের বি‌ভিন্ন স্থা‌নে মধু‌তে ভেজা‌লের কথা শোনা যায়, যা‌তে ৫% ও মধু থা‌কেনা। 

মধু সংরক্ষণঃ

মধু আমরা মুলত প্লা‌স্টি‌কের প‌টে প‌রিবহন ক‌রি, এটা সু‌বিধার কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদীভা‌বে মধু সংরক্ষণ কর‌তে কাঁ‌চের পাত্র বে‌শি ভাল। মধু ছে‌কে রাখ‌তে হ‌বে। প্রতিমা‌সে মধুর প‌টের ঢাকনা খু‌লে গ্যাস বের ক‌রে দি‌তে হ‌বে। মধু উচ্চ তা‌পে বা ফ্রিজে রাখ‌লে গুনগত মান ক‌মে যায় ব‌লে জানা যায়।

মধুর ভেজাল পরীক্ষাঃ

ভেজাল মধু সাধারণত মধু স্বা‌দের হয় না, যারা নিয়‌মিত মধু পান ক‌রেন তারা বুঝ‌বেন। মধুর পা‌নি দি‌য়ে পরীক্ষা, আগুন দি‌য়ে পরীক্ষাসহ কিছু যাচাই করাও যায়। ত‌বে খাঁ‌টি মধুর ফনা, গ্যাস, স্বাদ গুনগতমান সব অ‌ভিজ্ঞতা দি‌য়ে যাচাই করা যায়। প্রকাশ্য চাঁক কাটা মধুর সা‌থে বাজা‌রের মধুর মিল খু‌জে পে‌লেই মধু পান করা যায়। 

ব্রতীর মধু সংরক্ষণঃ

ব্রতী স্থানীয় প‌শ্চিম সুন্দরব‌নের মাওয়াল‌দের থে‌কে মধু ক্রয় ক‌রেন, কোন মহাজন থে‌কে মধু নেওয়া হয় না। ব্রতী এক‌টি নৌকা‌কে টা‌র্গেট ক‌রে সকল মধু তা‌দের থে‌কে নেওয়ার জন্য, ব্রতীর মাওয়ালরা সাধারণত সুন্দরব‌নের গহীন থে‌কে মধু নি‌য়ে আ‌সে। সনাতনী পদ্ধ‌তি‌তেই মধু সংগ্রহ ক‌রেন মাওয়ালরা। মধু প্লা‌স্টি‌কের ক‌ন্টিইনা‌রে থা‌কে, উক্ত মধু সম্পুর্ন প্রাকৃ‌তিক উপা‌য়ে সয়গ্রহের প‌রে, মধু‌তে মোম, মা‌ছি, গা‌ছের অংশ যুক্ত মধু মাওয়ালরা ব্রতী অ‌ফিসে সমার্পন ক‌রে। মধু শুধু মাত্র,ছাক‌নি ক‌রে স্থানীয় ভা‌বে বিক্রয় করা হয় ব্রতী থে‌কে। দে‌শের বি‌ভিন্ন স্থা‌নে কু‌রিয়ারও করা হয়। 

বন‌বিভা‌গের মধুর  তথ্য ২০২৩

পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সুন্দরবন অবস্থিত হলেও মূলত মধু পাওয়া যায় সাতক্ষীরা রেঞ্জে। এ জন্য প্রতিবছর  সনাত‌নী পদ্ধ‌তি‌তে ১ এপ্রিল মধু সংগ্রহ শুরু হয়ে চলত ৩০ জুন পর্যন্ত। ২০২৩ সালের মধু ও মোম আহরণের জন্য ১ হাজার ১২টি অনুমতিপত্র (পাস) দেওয়া হয়। এসব অনুমতিপত্রের বিপরীতে ৬ হাজার ৭৯৭ জন মৌয়াল সুন্দরবনে যান। তাঁরা ৩ হাজার ৩৭৬ দশমিক ৯০ টন মধু ও ১১৩ দশমিক শূন্য ৯ টন মোম আহরণ করেন। আর মধু থেকে ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩৬৩ টাকা ও মোম থেকে ১০ লাখ ২৫ হাজার ৮৫০ টাকা রাজস্ব আসে।

  • সাতক্ষীরার ঐতিহ‌্য সুন্দরব‌নের প্রাকৃ‌তিক চাঁ‌কের মধু ও মধুর সংগ্রহ ইতিহাস