নীলফামারীতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন মাহেরিন চৌধুরী

প্রকাশক: Dainik Jagroto Matrivumi
প্রকাশ: 2 hours ago

রংপুর প্রতিনিধি

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে, সেখানে নিজের জীবন উৎসর্গ করে অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে বাঁচিয়ে চিরবিদায় নেন সাহসী শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী(৪২)। মঙ্গলবার(২২ জুলাই) বিকাল ৪টায় নীলফামারীর জলঢাকা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরীপাড়াস্থ বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হন তিনি। পাশে ছিল দাদা জমিদার মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী ও দাদী মরহুম রওশনারা বেগম কবর।

জানাজায় গ্রামের শতশত মানুষসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়। চারিদিকে ছিল শোকের মাতন। বাড়ি ভর্তি মানুষ।

এর আগে ভোর সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের গজল আজম জামে মসজিদে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

মা ও স্ত্রীর শোকে পাথর হয়ে গেছেন মাহেরিন চৌধুরীর দুই সন্তান আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী ও আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী ও স্বামী মনসুর আলী হেলাল। চোখ ভেজা কান্না জড়িত কণ্ঠে নিহত মাহেরিনের স্বামী মনসুর আলী হেলাল বলেন, শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি। তিনি আরও বলেন, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওকে বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। আমার দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা এতিম হয়ে গেল।

মনসুর হেলাল বলেন, ও অনেক ভালো মানুষ ছিল। ওর ভেতরে একটা মায়া ছিল সবাইকে ঘিরে। আগুন লাগার পর যখন অন্যরা দৌড়াচ্ছিল, ও তখন বাচ্চাদের বের করে আনছিল। কয়েকজনকে বের করার পর আবার ফিরে গিয়েছিল বাকি বাচ্চাদের জন্য সেই ফেরাটা আর শেষ হয়নি। সেখানেই আটকে পড়ে, সেখানেই পুড়ে যায় আমার মাহেরীন। মাহেরিনের দুই ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী বলেন, আমরা গর্বিত, আমাদের মা নিজের জীবনের কথা চিন্তা না করে, আমাদের কথা চিন্তা না করে, জীবনের ঝুাঁকি নিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের মা একজন আসল যোদ্ধা।

মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী সেই নাম, যিনি আজ অমরত্ব লাভ করলেন নিজের জীবন দিয়ে ২০ জন শিক্ষার্থীকে আগুনের ভেতর থেকে টেনে বের করে। বিমান দুর্ঘটনায় মুহূর্তেই যখন চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন বাচ্চারা চিৎকার করছিল। সবাই যখন দৌড়ে পালাতে চাইছিল, মেহরিন ছুটে গিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে। একজন একজন করে বের করে আনতে আনতে তিনি নিজেই আগুনে দগ্ধ হন। শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন না, কিন্তু বাঁচিয়ে গেছেন অনেককে।

তিনি পারতেন পালাতে, পারতেন নিজেকে বাঁচাতে, কিন্তু তিনি শিক্ষক ছিলেন। শুধু পাঠদানে নয়, প্রাণ দিয়ে আদর্শ রচনা করার জন্য। একজন শিক্ষক কতটা মানবিক, কতটা দয়ালু হলে নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে পারেন শিক্ষার্থীদের জন্য। আজ দেশ ও প্রত্যেক মানুষ কাদছে। কিন্তু গর্বও করি মেহরিন চৌধুরীর মতো একজন শিক্ষক আমাদের দেশে ছিলেন।

মাহেরিন চৌধুরীর প্রতিবেশী আব্দুল জব্বার বলেন, প্রত্যেক বছরের দুই ঈদ ও মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন তিনি । এ সময় এলাকার গরিব মানুষকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কালভার্ট নির্মাণেও সহযোগিতা করেছেন। তিনি শিক্ষানুরাগী হিসেবে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হিসেবে তাঁকে মনোনীত করেছে এলাকাবাসী।

জানা যায়, মাহেরিন চৌধুরী শিক্ষকতার চাকরি জীবনে সবচেয়ে বেশী সময় পার করেছে নীলফামারীর জলঢাকায়। এরপর চলে যান ঢাকায়। সেখানে যোগদান করেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে তিনি স্কুলের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর(৩য় থেকে ৫ম শ্রেণীর) শিক্ষক ছিলেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরার একটি বাসায় বসবাস করতেন। মাহেরিন চৌধুরীর দুই ছেলে পড়াশোনা করছেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বড় ছেলে আয়ান রহীদ মিয়াদ চৌধুরী সদ্য এসএসসি পাশ করেছে ও ছোট ছেলে আদিল রহীদ মাহিব চৌধুরী নবম শ্রেণীতে পড়ছে। স্বামী মনসুর আলী হেলাল কম্পিউটার প্রকৌশলী। দুই বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহেরীন হচ্ছেন বড়।

তার বাবা মরহুম মহিতুর রহমান চৌধুরী ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আপন খালাতো ভাই। তার দাদি মরহুম রওশনারা বেগম ছিলেন জিয়াউর রহমানের মাতা মরহুম জাহানারা খাতুনের আপন বোন। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। এলাকা জুড়ে চৌধুরী বংসের ছিল অনেক নাম। তার দাদা মরহুম মজিবর রহমান চৌধুরী পিতা মাহফুজার রহমান চৌধুরী বগুলাগাড়ী স্কুলটি নির্মাণ করেছিলেন ১৮১৯ সালে। ১৯৭০ সালে তা বগুলাগাড়ী স্কুল এন্ড কলেজ নামে স্থাপিত করেন মজিবুর রহমান চৌধুরী। কিন্তু সময়ের সাথে এলাকায় ছিল না কেউ বংশের পরের প্রজন্ম। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি নিয়ে একের পর এক ঝামেলা লেগে ছিল। অবশেষে দাদা-বাবার রেখে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির স্মৃতিকে আগলে রাখতে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতো শিক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের স্বপ্ন নিয়ে দুই মাস আগে জলঢাকা বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হন তিনি।

  • নীলফামারীতে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন মাহেরিন চৌধুরী