লেখক: আব্দুর রহীম হাজারী
২০০১ সালে হাইকোর্ট থেকে দুইজন আইনজীবী ইসলামি রায় ফতোয়া বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা দিলে ইসলামের বিধান পালনের অধিকার আদায়ে ফুঁসে ওঠে বাংলার মুসলমানগণ। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ ঐ দুইজন আইনজীবীকে নাস্তিক ফতোয়া দেন, ইসলামি বিধান ফতোয়া রক্ষা ও ধর্মীয় অধিকার আদায়ে মাঠে নামার ঘোষণা দেন। তাতে তৎকালীন সরকার আলেম ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, গ্রেফতার করা হয় মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহঃ। উলামায়ে ইসলামের গ্রেফতার এর খবর শুনে মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ৫ই ফেব্রুয়ারী ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জনগণ মাঠে নেমে পড়লে রঈসুল মুফাস্সিরীণ আল্লামা সিরাজুল ইসলাম বড় হজুর রহঃ তাদেরকে শান্ত থাকার আহ্বান করেন ও পরদিন ৬ই ফেব্রুয়ারী ব্রাক্ষণবাড়িয়া গণসমাবেশ এর ঘোষণা দেন। ৬ই ফেব্রুয়ারী ব্রাক্ষণবাড়িয়া বড় হুজুরের নেতৃত্বে ধর্মীয় অধিকার আদায়ে সমাবেশ ও মিছিল হয়। শান্তিপূর্ণ এই সমাবেশ ও মিছিলে হামলা পুলিশ। শহীদ হন বড় হজুর রহঃ এর ছাত্র হাফেজ সাইফুল ইসলাম, তাজুল ইসলাম, মুখলেস সহ ৬ জন মুসলমান। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন অনেকে। পরদিন ৭ ই ফেব্রুয়ারিতে ইবনে বড় হজুর আল্লামা মনিরুজ্জামান সিরাজী রহঃ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ২০০৭ সালে ফখরুদ্দীন সরকারের সময়ে নারী নীতি নামক ধর্ম বিরোধী আইন করতে চাইলে মুসলমানদের তোপের মুখে তা করতে সক্ষম হয় নি। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে পিলখানা ট্রাজেডির নামে বাংলাদেশের সেনা শক্তি দুর্বল করে খোদ সরকার। ২০১১ সালে আবারও নারী নীতি নামক ধর্ম বিরোধী আইন করতে চাইলে মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ এর ইসলামি আইন বাস্তবতা কমিটি থেকে আন্দোলনের শুরু হয়ে যায়। জেলায় জেলায় বিক্ষোভ মিছিল আর প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী সারাদেশে হরতাল পালিত হয়, এই আন্দোলনে অসংখ্য মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে গ্রেফতার হতে হয়। ২০১২ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। এর বিরোধিতা করলে অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়। যুদ্ধাপরাধীর মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়ে কাউকে। আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী রহঃ কে মৃত্যু পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়েছে। এমনকি তাঁর জানাজায় পর্যন্ত বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। ২০১০ সালের ভারতের বরাক নদীর টিপাইমুখে বাঁধ দিলে পীর সাহেব চরমোনাই এর নেতৃত্বে টিপাইমুখ অভিমুখে লংমার্চ পালিত হয়। ২০১২ সালে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহঃ ও মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহঃ এর ইন্তেকাল এর পরে ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্বের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন সর্বজনীন মুরুব্বি আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহঃ। ২০১৩ সালে শাহবাগে নাস্তিক ব্লগাররা ধর্মদ্রোহী, রাসূলদ্রোহী ও খোদা দ্রোহী স্লোগান দিলে এর প্রতিবাদে আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহঃ এর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর ব্যানারে ১৩ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়, মুসলমানগন জান বাজি রেখে আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করে। জেলায় জেলায় থানায় থানায় পয়েন্টে পয়েন্টে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়, ৬ এপ্রিল ঢাকা লংমার্চ হয়, ৫ ই মে শাপলা চত্বরে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। এই দিন রাতের আঁধারে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে পাখির গুলি করে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও হাফেজ মাওলানা ও মাদ্রাসার ছাত্রকে শহীদ করা হয়। গ্রেফতার করা হয় আল্লামা জুনাইদ বাবু নগরী রহঃ ও আল্লামা মামুনুল হক সহ অনেককেই। ২০১৬ সালে শহীদ হয়েছে জামিয়া ইউনুছিয়া ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ছাত্র হাফেজ মাসউদুর রহমান। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর সামনে গ্রীক দেবীর মূর্তি স্থাপন করলে মুসলমানদের আন্দোলনের মোহে তা সরাতে বাধ্য হয় সরকার। ২০১৮ সালে গাড়ি চাপায় একজন ছাত্র মারা গেলে স্কুল কলেজ থেকে ছাত্ররা নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন করে। এই বছরই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে কোটা সংস্কার আইন হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচন ও ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ করা হলে আদায়ের লড়াইয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রাণহানি, জেল ও জুলুমের স্বীকার হতে হয়। মিথ্যা মামলা, গায়েবী মামলা এমনকি মৃত মানুষের নামেসহ মামলা দেওয়া হয়। এদিকে ২০২০ সালে আল্লামা আহমদ শফী রহঃ এর ইন্তেকাল হলে সর্বসম্মতিক্রমে আল্লামা জুনাইদ বাবু নগরী রহঃ কে হেফাজতে ইসলামের আমীর এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০২১ সালে ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী, ২০২১ সালের ২৬ শে মার্চ শুক্রবার জুমার নামাজের পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুজরাটের কসাই নরেন্দ্র মোদির আগমন কে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররমের সামনে মিছিলরত মুসল্লীদের উপর হামলা করলো পুলিশ, এতে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, হাটহাজারী তে চারজন শহীদ হলে ২৭ ও ২৮ মার্চ হরতাল ডাকা হয়। আন্দোলন তীব্র গতিতে চলে সরকারি বাহিনী মুসলমানদের উপর হামলা করে, ২৬,২৭ ও ২৮ মার্চ ব্রাক্ষণবাড়িয়াতে মাদ্রাসারও ছাত্র, শ্রমিক ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আরো ১৭ জন শহীদ হন। আন্দোলনে ভাঙচুরের অভিযোগে দেওয়া হয় শত মামলা, আল্লামা মামুনুল হক, আল্লামা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, খতীবে বাঙ্গাল আল্লামা জুনাইদ আল হাবীব ও আল্লামা সাখাওয়াত হোসাইন রাজি সহ অসংখ্য আলেম ওলামা তোলাবা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে জেলে বন্দী করা হয়, ২০২৪ সালে কোটা প্রথা পুনর্বহাল হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সরকার আন্দোলন প্রতিহত করতে চেষ্টা করে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশ এর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যায়, তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়, ঐ দিন সারা দেশে ৬ জন শহীদ হন, এতে আন্দোলন তীব্র গতিতে শুরু হয়ে গেলে সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়, সারা দেশে কারফিউ জারি করে। আন্দোলন তখন আর ছাত্র আন্দোলনে সীমাবদ্ধ নয় গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। তিন পর্যায়ে আন্দোলন চলে মাঠে ঘাটে আন্দোলন সাইবার আন্দোলন রেমিট্যান্স যুদ্ধাদের আন্দোলন তিন পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের থামাতে তিনটি পদক্ষেপ নেয় সরকার, মাঠ পর্যায়ের বীর যুদ্ধাদের থামাতে কারফিউ জারি করে, সাইবার যুদ্ধাদের থামাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, এবং রেমিট্যান্স যুদ্ধাদের তো হাতে পায়ে ধরে। কোটা সংস্কার এর এক দফা থেকে নিহতদের বিচার ও ইন্টারনেট সচল সহ নয় দফায় রুপান্তরিত হয় আন্দোলন। স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক কৃষক শ্রমিক সবাই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। জুলাই মাস শেষার্ধেকজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে তাদের জুলাই বিপ্লব নামে পরিচিত হয়। মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের পানি লাগবে পানি বলতে বলতে শহীদ হন। আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র গতিতে চলে, আগস্টে ৩ তারিখে নয় দফা থেকে একদফায় রূপ নেয়, এখনকার একদফা কোটা সংস্কার নয় এখনকার একদফা স্বৈরাচারী সরকার পতনের একদফা। ৪ আগস্ট বিকাল বেলা ঘোষণা করা হয় ৬ ই আগস্ট সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ কর্মসূচি পালন করা হবে কিন্তু সন্ধ্যা বেলা আবারও ঘোষণা হয় পরশু নয় আগামীকালই লংমার্চ টু ঢাকা এবং সেখান থেকে গণভবন অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গণভবন ঘেরাও করে স্বৈরাচার এর পতন ঘটানো হবে। ৫ ই আগস্ট কারফিউ ভঙ্গ করে লংমার্চ পালন করে সংগ্রামী ছাত্র জনতা গণভবন অভিমুখে রওয়ানা দিলে সেই খবর পেয়ে দাদার দেশে পালিয়ে গেল স্বৈরাচার সরকার। সমাপ্তি হলো একটা স্বৈরশাসক এর শাসন এর। এই ৭২ জন মাদ্রাসার ছাত্র সহ স্কুল কলেজ এর ছাত্র শিক্ষক শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ শহীদ হন।